অনলাইনে টিন সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশন করার নিয়ম ২০২৫
একটি রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তির জাতীয়তা প্রমাণের জন্য যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র থাকে তেমনি যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে আয়কর শনাক্তকরণ হিসেবে টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন।
বাংলাদেশে টিন সার্টিফিকেটের জন্য অনলাইনে আবেদন করা যায় যার জন্য কোনো প্রকার ফি প্রদান করতে হয় না এবং আবেদনের ৩ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এটি পাওয়া যায়।
নিচে টিন সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশন, প্রয়োজনীয়তা, ডকুমেন্টসসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচনা করা হয়েছে যা আপনাকে টিন সার্টিফিকেট সম্পর্কে জানতে এবং পেতে সাহায্য করবে।
টিন সার্টিফিকেট কী?
টিন বা TIN এর পূর্ণরূপ হচ্ছে Taxpayer Identification Number। এটি এমন একটি ডকুমেন্ট যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রদান করা হয়।
এর প্রধান কাজ হচ্ছে কর প্রদানের ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়কর শনাক্তকারী নম্বর হিসেবে কাজ করা। কোনো ব্যক্তি যদি করমুক্ত আয়ের মধ্যে থাকেন তাহলে টিন সার্টিফিকেট থাকাবস্থায় তাকে জিরো ইনকাম ট্যাক্স দাখিল করতে হবে।
টিন সার্টিফিকেট কেন দরকার?
টিন সার্টিফিকেট কেন দরকার? এই প্রশ্নের উত্তর নতুন অবস্থায় আমিও খুঁজেছিলাম। চলুন আপনাকে জানিয়ে দিই যে টিন সার্টিফিকেট আসলে কেন দরকার। নিচে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছি।
- যাদের আয় করমুক্ত আয়ের বাহিরে অর্থাৎ করযোগ্য ইনকামের ক্ষেত্রে কর প্রদান করতে হয়, আর কর প্রদানের জন্য অবশ্যই টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন।
- যদি কোনো নতুন ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স করতে চান বা ট্রেড লাইসেন্স নবায়নক করতে চান সেক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স দরকার হবে।
- ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যদি কোনো লোন গ্রহণ করতে চান সেক্ষেত্রেও এই টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন।
- ব্যবসায়িক উচ্চ লেনদেনের জন্য ব্যাংক একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রেও এটির প্রয়োজন হয়ে থাকে।
- আপনি যদি নতুন কোনো প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করতে চান তাহলে সেক্ষেত্রেও টিন সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক।
মোটকথা, টিন সার্টিফিকেট হলো আয়কর সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, যা ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়, ব্যাংক লেনদেন এবং অন্যান্য আর্থিক কার্যক্রমে প্রয়োজনীয়।
টিন সার্টিফিকেট কিভাবে পাওয়া যায়?
বাংলাদেশের টিন সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য পূর্বেকার যুগের মত আর স্থানীয় অফিসে জ্যাম লেগে বসে থাকতে হয় না।
বর্তমানে আপনি যদি একটি টিন সার্টিফিকেট অর্জন করতে চান, তাহলে বাসায় বসেই অনলাইনে টিন সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে পারবেন, এবং আবেদন করার সাথে সাথেই টিন সার্টিফিকেট প্রস্তুত, এবং সেটি প্রিন্ট করে ব্যবহার করা যাবে।
আমি মূলত ২০২১ সালের দিকে অনলাইনে টিন সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করেছিলাম, এবং সাথে সাথেই সেটি সংগ্রহ করতে পেরেছি।
নিচে টিন সার্টিফিকেটের জন্য কিভাবে আবেদন করতে হয় এবং এটি পেতে কি পরিমাণ সময় প্রয়োজন হয়, সেটা বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
টিন সার্টিফিকেট করতে কী কী লাগে?
অনলাইনে টিন সার্টিফিকেট আবেদন করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু তথ্য প্রদান করতে হবে। আবেদন করার পূর্বেই আপনার ডকুমেন্ট অনুযায়ী এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করে রাখুন, যেমন:
পার্সোনাল ইনফরমেশন, মোবাইল নাম্বার, আয়ের উৎস ও আয় সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য, বর্তমান এবং স্থায়ী ঠিকানা।
অনলাইনে টিন সার্টিফিকেট আবেদন করার নিয়ম
চলুন তাহলে এইবার আমরা ধাপে ধাপে জেনে নিন কিভাবে অনলাইনে টিন সার্টিফিকেট আবেদন করতে হয়। আমি কিভাবে আবেদন করেছিলাম, সেটি আপনাকে ধাপে ধাপে দেখিয়ে দিচ্ছি।
প্রথম ধাপ: একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করা
- অনলাইনে টিন সার্টিফিকেট আবেদন করার জন্য প্রথমেই আপনাকে ভিজিট করতে হবে ই-টিন রেজিস্ট্রেশন ওয়েবসাইটে।
- এখানে প্রবেশ করে আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে একটি অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করে নেওয়া।
- এজন্য উপরের মেনুবার থেকে Registrater বাটনে ক্লিক করুন।
- এরপর রেজিস্ট্রেশন করার জন্য একটি ফরম আসবে।
- এখানে প্রথমে একটি ইউজার আইডি তৈরি করে নিতে হবে। ইউজার আইডি অন্তত ৬ ক্যারেক্টারের হতে হবে, এবং নিচে মিনিমাম ৮ ক্যারেক্টারের একটি পাসওয়ার্ড তৈরি করে নিতে হবে।
- ইউজার আইডি এবং পাসওয়ার্ড অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কারণ পরবর্তীতে টিন সার্টিফিকেট ডাউনলোড কিংবা সংশোধন করার জন্য এগুলো প্রয়োজন হবে।
- এরপর আপনার তৈরি করা পাসওয়ার্ডটি রি-টাইপ পাসওয়ার্ড বক্সে প্রদান করুন।
- এরপর সিকিউরিটি কোশ্চেন নামে একটি বক্স দেখতে পাবেন।
এখানে আপনার পছন্দমত যে কোন একটি প্রশ্ন সিলেক্ট করতে হবে, এবং নিচে তার উত্তরটি লিখতে হবে। এর কাজ হচ্ছে, যদি আপনি কোন সময় আপনার ইউজার আইডি কিংবা পাসওয়ার্ড ভুলে যান, সে ক্ষেত্রে সিকিউরিটি কোশ্চেনের উত্তর দেওয়ার মাধ্যমে সেগুলো রিকভার করতে পারবেন। বিষয়টা দারুন না?
- আচ্ছা, এরপর আপনার কাজ হচ্ছে Country সিলেক্ট করা। এখানে অবশ্যই বাংলাদেশে সিলেক্ট করতে হবে, এবং নিচে আপনার মোবাইল নাম্বার প্রদান করুন।
- এরপর নিচে ইমেইল এড্রেস সেকশনে আপনার একটি Email প্রদান করুন, যদিও এটি বাধ্যতামূলক নয়।
- সমস্ত তথ্যগুলো দেওয়া হয়ে গেলে, রোবটিক অপশনটিতে টিক মার্ক দিয়ে Register বাটন ক্লিক করুন।
তাহলে ই-টিন রেজিস্ট্রেশন ওয়েবসাইটে আপনার একটি একাউন্ট তৈরি হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় ধাপ: একাউন্টে লগইন করা
- প্রথম ধাপে অ্যাকাউন্ট তৈরি হওয়ার পর, দ্বিতীয় ধাপে পুনরায় ই-টিন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন।
- এরপর মেনুবার থেকে লগইন বাটনে ক্লিক করে, আপনার তৈরি করা ইউজার আইডি এবং পাসওয়ার্ড প্রদান করে লগইন বাটনে প্রেস করুন।
- তাহলেই টিন রেজিস্ট্রেশন ড্যাশবোর্ডে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে।
তৃতীয় ধাপ: টিন রেজিস্ট্রেশন করা
- টিন সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশনের তৃতীয় পর্যায়ে এসে, আপনাকে রেজিস্ট্রেশন ফর্ম ধাপে ধাপে পূরণ করতে হবে।
- ড্যাশবোর্ডের বাম পাশে যে অপশনগুলো রয়েছে, এখান থেকে সবার প্রথমে দেখবেন TIN Application বাটন রয়েছে। এখানে ক্লিক করুন।
- এরপর একটি ফরম চলে আসবে, এখানে বেশ কিছু তথ্য সিলেক্ট করতে হবে, যেমন: করদাতার ধরন, রেজিস্ট্রেশনের ধরন, উদ্দেশ্য, আয়ের প্রধান উৎস, আয়ের লোকেশন ইত্যাদি।
- এখানে করদাতার ধরন বক্সে অবশ্যই ‘Individual Bangladeshi‘ সিলেক্ট করতে হবে।
- দ্বিতীয় বক্সে, আপনার যদি এনআইডি কার্ড থাকে, তাহলে ‘Having NID‘ অপশনটি সিলেক্ট করুন।
- এরপর, আপনার যদি ইতোপূর্বে কোন টিন সার্টিফিকেট না থাকে, তাহলে রেজিস্ট্রেশন ধরন বক্সে ‘New Registration‘ সিলেক্ট করুন।
- এরপর ‘Purpose of TIN‘ এই বক্সে আপনি কেন টিন রেজিস্ট্রেশন করছেন সেটি সিলেক্ট করে দিন।
- এরপর, আপনার আয়ের প্রধান উৎস এবং লোকেশনগুলো সিলেক্ট করে ‘Next‘ বাটনে ক্লিক করুন।
- এর পরবর্তী পেইজে প্রেজেন্ট এবং পার্মানেন্ট অ্যাড্রেসের তথ্যগুলো প্রদান করতে হবে। সুতরাং, আপনার প্রেজেন্ট এবং পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস ভালোভাবে পূরণ করে ‘Go to Next‘ বাটনে ক্লিক করুন।
- এরপর, আপনার টিন সার্টিফিকেট অ্যাপ্লিকেশন সম্পন্ন হয়ে যাবে।
- এরপর আপনি আপনার দেওয়া তথ্যগুলোর একটি প্রিভিউ দেখতে পারবেন। কোন তথ্য ভুল হয়ে থাকলে, অবশ্যই সেগুলো সংশোধন করে নিন।
- আর যদি সমস্ত তথ্য ঠিক থাকে, তাহলে এখানে একটি টিক চিহ্ন দেওয়ার বক্স থাকবে। এখানে টিক চিহ্ন দিয়ে ‘Submit Application‘ বাটনে ক্লিক করে আবেদনটি সম্পন্ন করতে হবে।
Congratulation! আপনার টিন সার্টিফিকেট ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়েছে।
এখানে আপনার ছবি সহ আবেদনপত্রের একটি পেইজ আসবে, এখানে নিচে দেখবেন ‘ভিউ সার্টিফিকেট’ নামে একটি বাটন রয়েছে। এখানে ক্লিক করলে, আপনি আপনার টিন সার্টিফিকেটটি দেখতে পাবেন।
এখানে ‘Print‘ অপশনে ক্লিক করে, আপনি সরাসরি এটি প্রিন্ট করে নিতে পারবেন, কিংবা ‘Save Certificate বাটনে ক্লিক করলে, আপনি আপনার ডিভাইসে ডাউনলোড করে নিতে পারবেন এবং পরবর্তীতে যে কোন প্রিন্ট সার্ভিস থেকে এটি প্রিন্ট করে নিয়ে ব্যবহার করা শুরু করতে পারবেন।
ব্যাস, হয়ে গেল! এই পদ্ধতিতেই মূলত একদম ঝামেলা বিহীনভাবে, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই টিন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা যায়।
টিন সার্টিফিকেট সংক্রান্ত প্রশ্নোত্তর
টিন সার্টিফিকেট সংক্রান্ত এখানে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর উপস্থাপন করা হয়েছে।
টিন সার্টিফিকেট থাকলে কি কর দিতে হবে?
আপনার আয় যদি করমুক্ত সীমার মধ্যে থাকে, তাহলে আপনাকে কোন আয়কর দিতে হবে না। তবে যদি করমুক্ত সীমার বাহিরে থাকে, তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশ কর বিধি অনুযায়ী কর প্রদান করতে হবে।
তবে, যদি আপনার আয় করমুক্ত সীমার মধ্যে থাকে এবং কোন প্রদান করতে না হয়, সে ক্ষেত্রে টিন সার্টিফিকেট থাকলে আপনাকে অবশ্যই প্রতিবছর ‘জিরো ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন’ করতে হবে।
জিরো ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন না করলে কি সমস্যা হবে?
জিরো ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন যদি আপনি না করেন, তাহলে আপনি বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন, যেমন আপনার টিন সার্টিফিকেটটি বাতিল হয়ে যেতে পারে, পরবর্তীতে আয়কর রিটার্নের ক্ষেত্রে আপনাকে জরিমানা গুনতে হতে পারে।
সুতরাং, এসব ঝামেলা এড়াতে, অবশ্যই জিরো ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন করা ভালো, যদি আপনার আয়কর মুক্ত সীমার মধ্যে থাকে।
টিন সার্টিফিকেট কি নবায়ন করতে হয়?
না, টিন (TIN) সার্টিফিকেট সাধারণত নবায়ন করতে হয় না। একবার ইস্যু করার পর এটি আজীবনের জন্য বৈধ থাকে, যতক্ষণ না আপনার তথ্য পরিবর্তন বা আপডেট করার প্রয়োজন হয়।
তবে, যদি আপনার ব্যবসার তথ্য, নাম, ঠিকানা বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবর্তন হয়, তাহলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR)-এ গিয়ে আপডেট করে নিতে হবে।
টিন সার্টিফিকেট করতে কি কোন খরচ প্রয়োজন হয়?
না, বাংলাদেশের টিন সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য কোন প্রকার ফি প্রদান করতে হয় না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে এটি সম্পূর্ণ ফ্রিতে প্রদান করা হয়।
শেষ কথা
তো, প্রিয় টিন সার্টিফিকেট প্রত্যাশী বন্ধুরা, আমার টিন সার্টিফিকেট প্রাপ্তি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা আপনার সাথে শেয়ার করলাম। এখন আপনি আমার এই অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে, আপনিও খুব সহজেই একটি টিন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে পারেন।
এছাড়াও, যদি আপনি আরো কিছু জানতে চান, কিংবা টিন সার্টিফিকেট আবেদন করতে গিয়ে কোন কিছু বুঝতে না পারেন, বা কোন সমস্যায় পড়েন, তাহলে আপনি পেইজের কমেন্ট বক্সে গিয়ে আপনার সমস্যাটি জানাতে পারেন।
আমাদের টিম যত দ্রুত সম্ভব আপনাকে রেসপন্স করার এবং সাহায্য করার চেষ্টা করবে, ইনশাআল্লাহ।